বড়লোক ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে


চন্দনপুর গ্রামের নাম শুনলেই মনে পড়ে নদীর কলতান, বাঁশঝাড়ের শব্দ আর সন্ধ্যায় স্কুলের শেষ ঘণ্টা। গ্রামের এক প্রান্তে ছোট্ট ইটের বাড়ি—সামনে তুলসীতলা, পিছনে আমগাছ। এই বাড়িতেই থাকত প্রিয়াঙ্কা। বয়স বাইশ। চোখ দুটো যেন কাজলের রেখায় আঁকা, হাসি যেন ফুলের পাপড়ি। কলকাতায় এম.এ. পড়তে গিয়েছিল, ছুটিতে এসেছে। বাবা রমেশ মণ্ডল স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মা সুধা সংসারের রাণী। একমাত্র মেয়ে বলে প্রিয়াঙ্কা সবার চোখের মণি। এক সকালে বাজারে যাচ্ছিল প্রিয়াঙ্কা। হাতে ঝুড়ি, গায়ে হলুদ শাড়ি। হঠাৎ একটা লাল SUV থামল। গাড়ি থেকে নামল আশিক রায়। চোখে রোদচশমা, গায়ে সাদা লিনেন শার্ট, হাতে দামি ঘড়ি। গ্রামে এমন ছেলে দেখা যায় না।

“এই মেয়ে, একটু দাঁড়াও। থানার রাস্তা কোনদিকে?”  
প্রিয়াঙ্কা থমকে দাঁড়াল। “সোজা গিয়ে বাঁদিকে। আপনি কে?”  
“আশিক রায়। শহর থেকে এসেছি। বাবার জমি দেখতে।”  
প্রিয়াঙ্কা হাসল। “জমি দেখতে এত দামি গাড়ি?”  
আশিকও হাসল। “গাড়ি বাবার। আমি তো শুধু চালাই।”

প্রিয়াঙ্কা চলে গেল। কিন্তু আশিকের চোখ আটকে রইল তার হাসিতে। গাড়িতে উঠে সে নিজের মনেই বলল, “এই মেয়েটা অন্যরকম।”

আশিকের বাবা রতন রায়—কলকাতার নামকরা বিল্ডার। চন্দনপুরে তাদের পৈতৃক বাড়ি আর দশ বিঘা জমি। রতনবাবু শুনেছেন, রমেশবাবু স্কুলের পাশের জমি বিক্রি করতে চান না। তিনি চান সেই জমি দিয়ে রিসর্ট বানাতে। এক সন্ধ্যায় রমেশবাবুর বাড়ি গেলেন।

“দাদা, আপনার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা খুব সুন্দর। আমার ছেলে আশিকের জন্য উপযুক্ত।”  
রমেশবাবু চমকে উঠলেন। “বিয়ের কথা? এখনও তো ওর পড়াশোনা শেষ হয়নি!”  
“আমরা দায়িত্ব নেব। আপনার স্কুলের জমির বিনিময়ে বিয়ে—দুটোই সমাধান।”  
রমেশবাবু মাথা নাড়লেন। “আমার মেয়ে জিনিস নয়।”  
রতনবাবু হাসলেন। “টাকা দেব। পঞ্চাশ লাখ। নইলে জমি জোর করে নেব।”

রমেশবাবু রাতে ঘুমাতে পারলেন না। সুধা বললেন, “আমাদের মেয়ের সুখ কিনে দেবে টাকা?”  
কিন্তু রতনবাবুর লোক গ্রামে ছড়িয়ে দিল—রমেশবাবু ঋণগ্রস্ত, জমি বিক্রি না করলে জেলে যাবেন। গ্রামের মানুষ কানাঘুষো শুরু করল।

এক রাতে প্রিয়াঙ্কা ঘুমিয়ে। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। তিনজন লোক ঢুকে তার মুখ চেপে ধরল। “চুপ করো। নইলে বাবা-মায়ের ক্ষতি।”  
প্রিয়াঙ্কা কাঁদতে লাগল। কিন্তু কেউ শুনল না। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কলকাতায়।

রতনবাবুর বাড়ি। বিশাল হলঘর, ঝাড়লণ্ঠন, ফুলের সাজ। প্রিয়াঙ্কাকে লাল বেনারসি পরিয়ে দেওয়া হলো। সোনার গয়না, কপালে সিঁদুর। সামনে আশিক। তার মুখ ফ্যাকাশে।

“আমি বিয়ে করব না!” প্রিয়াঙ্কা চিৎকার করল।  
রতনবাবু ফিসফিস করে বললেন, “তোমার বাবা-মা আমাদের হাতে। সই করো।”  
প্রিয়াঙ্কা কাঁপতে কাঁপতে সই করল। সাত পাকে বাঁধা পড়ল দুজনে। কিন্তু তার চোখে শুধু ঘৃণা।

বিয়ের পর আশিকের ফ্ল্যাটে এলো প্রিয়াঙ্কা। পঞ্চম তলা, কাঁচের জানালা, শহরের আলো। কিন্তু তার মন অন্ধকার। আশিক চেষ্টা করল কথা বলতে।

“আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করো। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।”  
প্রিয়াঙ্কা ঠান্ডা গলায় বলল, “ভালোবাসা জোর করে হয় না।”  
রাতে প্রিয়াঙ্কা ছাদে দাঁড়িয়ে কাঁদে। আশিক পিছনে এসে দাঁড়ায়।  
“গ্রামে ফিরে যেতে চাও?”  
“চাই। কিন্তু বাবা-মা এখন বন্দি।”

আশিকের মন ভারী হলো। সে বাবাকে বলল, “এটা ঠিক হয়নি।”  
রতনবাবু হেসে উড়িয়ে দিলেন। “ছেলে হয়ে মেয়েছেলের কথা শুনছিস?”

কিন্তু আশিক রাতে গোপনে গ্রামে গেল। রমেশবাবু-সুধাকে মুক্ত করে কলকাতায় নিয়ে এল। তাদের একটা ফ্ল্যাটে রাখল। প্রিয়াঙ্কা জানে না।

একদিন প্রিয়াঙ্কা জ্বরে পড়ল। আশিক রাত জেগে ওষুধ আনল, হাতে খাইয়ে দিল।  
“কেন এত কষ্ট করছ?”  
“তুমি আমার স্ত্রী।”  
প্রিয়াঙ্কার চোখে প্রথমবার একটু নরম।

রতনবাবু জানতে পারলেন আশিক প্রিয়াঙ্কাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তিনি রিচা নামে এক মেয়েকে পাঠালেন। রিচা এসে বলল, “আশিক, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওই গ্রামের মেয়ে তোমার যোগ্য নয়।”  
আশিক বলল, “আমার স্ত্রী একজনই—প্রিয়াঙ্কা।”

একদিন প্রিয়াঙ্কা শুনতে পেল আশিক তার বাবা-মাকে মুক্ত করেছে। সে ছাদে গিয়ে আশিককে জড়িয়ে ধরল।  
“তুমি আমার জন্য এত কিছু করলে?”  
“আমি ভুল করেছিলাম। এখন শুধরে নিতে চাই।”

দুজনে একসঙ্গে বসে গ্রামের স্মৃতি বলল। প্রিয়াঙ্কা প্রথমবার হাসল।

আশিক বাবাকে বলল, “আমি কোম্পানি ছেড়ে দিচ্ছি। প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে গ্রামে থাকব।”  
রতনবাবু রাগে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রিয়াঙ্কা তার কাছে গেল।  
“বাবা, আমি আপনার ছেলেকে ভালোবাসি। আমাকে মেনে নিন।”  
রতনবাবু চোখ বন্ধ করলেন। কিন্তু মনে মনে রাজি হলেন।

আশিক আর প্রিয়াঙ্কা চন্দনপুরে ফিরে এল। স্কুলের জমি বাঁচানো হলো। আশিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করল। প্রিয়াঙ্কা গ্রামের মেয়েদের পড়াতে লাগল।

“আমার বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তোমার পাশে থাকাটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ।”  
“জোর করে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ভালোবাসা এসেছে নিজে থেকে।”

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রিয়াঙ্কার কোলে একটা মেয়ে। নাম—আশা। রতনবাবু এসে নাতনিকে কোলে নিলেন।  
“আমি ভুল করেছিলাম। তোমরা আমাকে ক্ষমা করেছ।”  
“আপনি আমাদের বাবা।”

সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে দুজনে হাত ধরে বসে।  
“ভালোবাসা জোর করে আসে না। কিন্তু একবার এলে, আর যায় না।”

*সমাপ্ত।*


 

Post a Comment

0 Comments